ঐকতান কবিতার ব্যাখ্যা ও হ্যান্ডনোট


ঐকতান কবিতা সম্পর্কে কিছু কথা:

কবিতাটি একটি আত্নসমালোচনা মূলক কবিতা । কবি তার শেষ জীবনে গিয়ে তার জীবনকে উপলদ্ধি করেছেন। তার জীবনের পেছনের দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখেছেন যে, তিনি জীবনে কি করলেন। তিনি উপলদ্ধি করে বুঝেছেন যে, তার লেখাগুলো বিচিত্রপথে অগ্রসর হলেও জীবনের সকল স্তরে পৌছাতে পারেনি। কারণ হলো কবির আবিজাত্য । তিনি িসমাজের উচ্চ মঞ্চে বসে দরিদ্র, গরীব নিচু মানুষদের সাথে মিশতে পারেনি। তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে তাদের জীবনকে উপলদ্ধি করতে পাইনি । এটাই তার জীবনের ব্যার্থতা । এজন্য তিনি প্রত্যাশা করেছেন এমন ভবিষ্যতের কবি, যারা এই শ্রমজীবি মানুষদের অংশীদার হয়ে সত্য ও কর্মের মধ্যে সৃষ্টি করবেন আত্মীয়তার বন্ধন।

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য :
  • কাব্যগ্রন্থ - ৫৬ টি
  • উপন্যাস- ১২ টি
  • নাটক- ২৯ টি
  • গল্পগ্রন্থ - ৩ টি (গল্পগুচ্ছ, গল্পসল্প, গল্পসপ্তক)
  • বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা- বিশ্ব পরিচয়
  • ছোটগল্প - ১১৯
  • গান- ২২৩২ [বিতর্কিত]
  • আঁকা ছবি- প্রায় ২০০০
  • ভ্রমণকাহিনী - ৯ টি
কবিতার ব্যাখ্যা:

বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।
দেশে দেশে কত- না নগর রাজধানী-
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত- না অজানা জীব, কত- না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগোচরে। 

ব্যাখা:- এই পৃথিবী বিশাল এবং বিপুল আয়তনের। এখানে জানার মত কত্ত কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু তার কতটুকুই বা জানি! দেশে দেশে কতই না শহর-রাজধানী আছে। মানুষের কত কীর্তি, নদী, গিরি (পাহাড়), সিন্ধু (সাগর), মরু (মরুভুমি) ই না আছে এই বিশালাকার পৃথিবীতে! কত অজানা জীব, অপরিচিত গাছপালা এখনো আমার জানার বাহিরেই রয়ে গেল। আমি তার সান্নিধ্য ও পেলাম না।

বিশাল বিশ্বের আয়োজন;
মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।
সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে
অক্ষয় উৎসাহে -

ব্যাখা: এ বিশ্বের আয়োজন বিশাল। কিসের আয়োজন! জানার/জ্ঞান আহরণ করার আয়োজন। কিন্তু, কবির মন তারই ক্ষুদ্র এক কোণ জুড়ে থাকে। অর্থাৎ, কবি এখানে তার জানার সীমাবদ্ধতাটুকু অকপটে প্রকাশ করেছেন। কবি, সেই ক্ষোভে, অর্থাৎ জানার সীমাবদ্ধতার ক্ষোভে বই পড়েন। ভ্রমণকাহিনী পড়েন। অর্থাৎ, কবি হয়ত সকল দেশ, সকল রাজধানী, সকল অজানা কিছু জানতে পারেন নি। এটা তার সীমাবদ্ধতা। কিন্তু, তিনি তার সীমাবদ্ধতাটুকু দূর করার জন্য বই বা ভ্রমণকাহিনী পড়ছেন। যাতে করে, সমস্ত দেশ বা নগর না ঘুরলেও যাতে কবি সব জায়গা থেকে কিছু হলেও জ্ঞানার্জন করতে পারেন।

যেথা পাই চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী
কুড়াইয়া আনি।
জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে
পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষালব্ধ ধনে।

ব্যাখা: একটা প্রবাদ আছে। Pictures say thousand words! অর্থাৎ, কোনো কিছুর সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ জানার জন্য, তুমি যদি খালি গৎবাধা লেখা পড়ো, তাহলে তোমার জানাটা স্বল্পস্থায়ী হবে। কিন্তু, বর্ণনাটা যদি চিত্রময়ী হয়, বা যদি ছবির মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়, তবে সেই জানাটা তোমার মনে দাগ কেটে যাবে। কবি এই চিত্রময়ী বর্ণনাগুলোকেই কুড়িয়ে আনেন। কবি আরো বলেছেন, তার জ্ঞানের দীনতা আছে। অর্থাৎ, তিনি জ্ঞানের দিক থেকে গরীব। কিন্তু, তারপর ও তিনি বিভিন্ন সূত্র থেকে জ্ঞান আহরণ করে তার জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেন।

আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি
আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি,

ব্যাখা: কবি নিজেকে পৃথিবীর কবি হিসেবে ঘোষিত করেছেন। এবং বলেছেন, মানুষেরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, কবির বাঁশির সুর [এখানে, কবিতার সুর] সর্বত্রই সাড়া প্রদান করবে।

এই স্বরসাধনায় পৌঁছিল না বহুতর ডাক -
রয়ে গেছে ফাঁক।

ব্যাখা: অর্থাৎ, কবির কবিতার সূর সর্বত্র পৌঁছাতে পারেনি। কবির চাওয়া, এবং তার কবিতার সুর প্রান্তিক মানুষের পাওয়ার মধ্যে এখনো বিস্তর ব্যবধান বা ফারাক রয়েই গেছে।

প্রকৃতির ঐকতানস্রোতে
নানা কবি ঢালে গান নানা দিক হতে;

ব্যাখা: রবিঠাকুর বলেছেন, তার মতই আরো অনেক কবি, বিভিন্ন দিক থেকে কবিতা রচনা করে। এবং সেই কবিতার সূরগুলো পৌঁছে দিতে চায় মানুষদের কাছে।

তাদের সবার সাথে আছে মোর এইমাত্র যোগ-
সঙ্গ পাই সবাকার, লাভ করি আনন্দের ভোগ,

ব্যাখা: অর্থাৎ, ঐ সকল কবির সাথেই রবিঠাকুর এর যোগাযোগ রয়েছে। এবং তাদের সবার সঙ্গ পেয়ে কবি বরং আনন্দিতই হন।

পাই নে সর্বত্র তার প্রবেশের দ্বার,
বাধা হয়ে আছে মোর বেড়াগুলি জীবনযাত্রার। 

ব্যাখা: অর্থাৎ, রবিঠাকুর চাইলেও সেই সকল কবির সাথে মিশতে পারেন না। কেননা, কবিগুরুর জীবনযাত্রা আর তাদের জীবনযাত্রায় যে এখনও ব্যবধান! এখানে খুব সম্ভবত ধনী-গরীব শ্রেণীর ব্যবধান এর ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।

চাষি খেতে চালাইছে হাল,
তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল-
বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার
তারি পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার। 

ব্যাখা: এখানে কবি, সমাজের প্রান্তিক/শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর পেশাকে মর্যাদা দিয়েছেন। এবং বলেছেন, তাদের কাজের উপর নির্ভর করেই সংসার এগিয়ে যাচ্ছে।

অতি ক্ষুদ্র অংশে তার সম্মানের চিরনির্বাসনে
সমাজের উচ্চ মঞ্চে বসেছি সংকীর্ণ বাতায়নে।

ব্যাখা: কবি এখানে বলেছেন, তিনি সমাজের উচ্চ মঞ্চে আসন গ্রহন করেছেন। এবং সাধারণ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। ফলে, সেই উঁচু মঞ্চের সংকীর্ণ জানালা দিয়ে সাধারণ মানুষদের এ বড় সমাজটিকে তিনি দেখতে পারেন নি।


 
মাঝে মাঝে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে,
ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে।

ব্যাখা: কবি মাঝে মাঝে ঐ সকল সাধারণ শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর পাড়ায় উঁকি দিয়েছেন। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের সাথে ভালোভাবে যোগসূত্র রচনা করতে পারেন নি।

জীবনে জীবন যোগ করা
না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।

ব্যাখা: কবির কবিতা যদি জীবনের সাথে জীবনই যোগ করতে না পারে, অর্থাৎ ধনী-গরীব/উচ্চশ্রেনী-নিম্ন
শ্রেনীর মাঝে অপূর্ব মেলবন্ধনই তৈরি করতে না পারে, তবে সেই কবিতা মূল্যহীন। এসব প্রান্তিক মানুষকে শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে যোগ্য স্থান দিলেই কেবল সাহিত্যসাধনা পূর্ণতা পায়।

তাই আমি মেনে নিলাম সে নিন্দার কথা
আমার সূরের অপূর্ণতা।
আমার কবিতা, জানি আমি,
গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।

ব্যাখা: কবি নিজের সীমাবদ্ধতাটুকু মেনে নিলেন। অনেকেই কবির নামে নিন্দে করত, যে তিনি শুধু বাবুসাহেব দেরকে নিয়েই সাহিত্য রচনা করেন। কবি সেই নিন্দেটুকুও মেনে নিলেন। কবি নিজেই জানেন, তার কবিতা বিচিত্র পথে গেলেও সর্বত্র পৌঁছাতে পারেনি।

কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,

ব্যাখা: কৃষকের জীবনের মত জীবন যে অতিবাহিত করতে পারছে, সে সত্যিই কথায় ও কাজে আত্মীয়তা অর্জন করতে পেরেছে।
আত্মীয়তা? কাদের সাথে আত্মীয়তা?
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাথে।

এসো কবি অখ্যাতজনের
নির্বাক্ মনের।
মর্মের বেদনা যত করিয়া উদ্ধার-

ব্যাখা: বিখ্যাত শব্দের বিপরীত হল অখ্যাত। এখানে, রবিঠাকুর এমন কবিকে আহবান করছেন, যিনি এসব অখ্যাত মানুষদের জীবনকে আবিষ্কার করতে পারবেন। অর্থাৎ, সাধারণ কর্মজীবী মানুষদের জীবনকে কবিতার দ্বারা তুলে ধরার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি, কবিগুরুর কবিতা সর্বত্রগামী না হওয়ার যে ব্যাথা, সেই মর্মের ব্যাথা উদ্ধার করার জন্য তিনি নতুন কবিকে আহবান করেছেন।

প্রাণহীন এ দেশেতে গানহীন যেথা চারি ধার,
অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক নিরানন্দ সেই মরুভুমি
রসে পূর্ণ করি দাও তুমি।

ব্যাখা: কবি এখানে বুঝাতে চেয়েছেন, যে সাহিত্যের ভুবন আনন্দহীন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। কারণ, সমাজের শ্রমজীবী মানুষেরা সাহিত্যসভায় উপেক্ষিত। তারা সাহিত্যে স্থান পায়নি। এজন্য কবি আহবান করেছেন নতুন আরেক কবিকে, যিনি এসব শ্রমজীবী মানুষদের স্থান দিবেন সাহিত্যের ভুবনে। এবং সাহিত্যভুবন এর উষরতা (শুষ্কতা) কে রসে পূর্ণ করে দিবেন।

অন্তরে যে উৎস তার আছে আপনারি
তাই তুমি দাও গো উদবারি।

ব্যাখা: উদবারি মানে হল, উপরে বা উর্ধ্বে প্রকাশ করা। কবি বলছেন, হে নতুন কবি, তোমার অন্তরে যে রসের উৎস আছে, তা উন্মুক্ত করে দাও।

 সাহিত্যের ঐকতানসংগীতসভায়
একতারা যাহাদের তারাও যেন সম্মান পায় -

ব্যাখা: অর্থাৎ, সাহিত্যের সভায়, যেখানে জীবনের সূর যোগ করা হয়, সেখানে যেন অবজ্ঞাত বা উপেক্ষিত মানুষেরাও সম্মান লাভ করে।

মূক যারা দু:খে সুখে,
নতশির স্তব্ধ যারা বিশ্বের সম্মুখে,
ওগো গুণী,
কাছে থেকে দূরে যারা তাহাদের বাণী যেন শুনি।

ব্যাখা: কবি বলেছেন, তিনি সেসব লোকেদের বাণী শুনতে চান, যারা কাছে থেকেও দূরে। যারা দু:খ-সুখ সহ্য করা নির্বাক মানুষ। যারা এগিয়ে চলা পৃথিবীতে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।

পাঠ পরিচিতি থেকে:

  • ঐকতান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (জন্মদিন) কাব্যগ্রন্থের ১০ সংখ্যক কবিতা।
  • কবিতাটি সমলি প্রবহমান অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত।
  • কবিতাটিতে ৮+৬ এবং ৮+১০ মাত্রার পর্বই অধিক।
  • ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যা  প্রবাসিতে কবিতাটি ঐকতান নামে প্রথম প্রকাশিত হয়।

Xem thêm