সাম্যবাদী কবিতার ব্যাখ্যা ও হ্যান্ডনোট

মূলকথাঃ কবি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গােত্র নির্বিশেষে সকল ব্যবধান ভুলে মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনায় এনে সকলকে সমান ভাবতে হবে। ধর্মীয় হানাহানি ত্যাগ করে হৃদয় ধর্মকে প্রাধান্য দিতে হবে। কবির মতে এর মাধ্যমেই সকল ধর্মের মহামানব ও দেবতারা মানুষদের হৃদয় জয় করেছে। এর চেয়ে উত্তম কোন কিছু এ ধরনীতে নেই।

কবিতার  ব্যাখ্যা:

গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান। 

ব্যাখা: কবি প্রথমেই সাম্যের গান তথা সকল মানুষের মাঝে সমতার আহ্বান জানিয়েছেন। আহ্বান জানিয়েছেন সব ধর্মীয় বাঁধা ব্যবধান মিশিয়ে দিয়ে হিন্দু মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানদের এক হবার। কবি সকল ধর্মের এই ভেদাভেদকে ভুলে গিয়ে সকলকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে সমতার কথা বলেছেন।

গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি?- পার্সী? জৈন? ইহূদী সাঁওতাল, ভীল, গারাে?
কনফুসিয়াস্? চার্বআখ চেলা? বলে যাও, বলাে আরাে!

ব্যাখ্যা: কবি এখানে মানুষের পরিচয় নিয়ে কথা বলেছেন , কেননা এসব ধর্মীয় পরিচয়ই মানুষ বেশি দিয়ে থাকে। পাশাপাশি তিনি কিছু উদাহরন দেন পার্সি, জৈন, ইহূদী, ইত্যাদি। কবি কিছুটা প্রশ্নের স্বরে পরিচয় জিজ্ঞেস করে এসব উদাহরন দিয়েছেন। চরন শেষে উল্লেখ করেছেন

বলে যাও, বলাে আরাে" , এর মাধ্যমে তিনি
বুঝিয়েছেন ধরনীতে অগনিত ধর্ম রয়েছে যেগুলাে কবির মতে মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির মূল।
বন্ধু, যা খুশি হও,
পেটে-পিঠে, কাঁধে-মগজে যা খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান- পুরাণ- বেদ-বেদান্ত- বাইবেল- ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা -গ্রন্থ-সাহেব পড়ে যাও যত সুখ,
কিন্তু কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?

ব্যাখ্যা: কবি অতঃপর বলেছেন এসব ধর্মের ধর্মীয় পুস্তক সমূহের ব্যাপারে। প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা অন্যান্য ধর্মের ন্যায় নয় বরং ভিন্ন কিতাব বা বই বা ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করেন। ফলে এখানেও এক ধরনের বিভেদ রয়েছে। কবি আবার জিজ্ঞেস করেন কেন এই কষ্ট করে কিতাব পাঠ করা হচ্ছে যা দ্বারা মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি হয়?

দোকানে কেন এ দর-কষাকষি? পথে ফোটে তাজা ফুল।
তােমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ।

ব্যাখ্যা: দোকানে দর কষাকষি বলতে কবি দর দামের কথা বলেন নি। এখানে এক ধর্মের সাথে আরেক ধর্মের বিরােধের কথা কে বুঝিয়েছেন। পথে তাজা ফুল ফোটা বলতে বুঝিয়েছেন ধর্মীয় বিদ্বেষ নিয়ে মারামারি, হানাহানি, ও হত্যাকান্ডকে । কবি বলেছেন এসকল পুস্তকের মধ্যে যা রয়েছে তা সকল মানুষের মাঝেই বিদ্যমান। নিজেকে উপলব্ধি করতে হবে যাকে কবি নিজের প্রান খুলে দেখা " বলে আখ্যা দিয়েছেন।

তােমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তােমার হৃদয় বিশ্ব- দেউল সকলের দেবতার।
কেন খুঁজে ফের দেবতা- ঠাকুর মৃত- পুথি-কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত- হিয়ার নিভৃত অন্তরালে।

ব্যাখ্যা: কবি এখানে হৃদয় ধর্মের প্রতি ডাক দিয়েছেন। তার মতে মানুষের হৃদয় দেবতাদের বিশ্ব
মন্দির। তাহলে শুধু শুধু কেন দেবতা,ঠাকুর, পুথি কঙ্কাল ইত্যাদির খোঁজ করবাে আমরা। কবির ভাষায় সকল দেবতা আমাদের হৃদয় মাঝে লুকিয়ে হাসছেন।

বন্ধু, বলিনি ঝট,
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট
এই হৃদয়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধগয়া এ, জেরুজালেম এ, মদিনা, কাবা- ভবন,

ব্যাখ্যা : কবি বললেন, তিনি কোন মিথ্যা কথা বলছেন না। হৃদয়ের কাছে এসে সকল রাজমুকুট তথা সকল শক্তি লুটিয়ে পরে বা পরাজিত হয়। কবি তারপর বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন পবিত্র স্থানের সাথে হৃদয়ের উপমা দেন।

মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে বসে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
এই রণভূমে বাঁশির কিশাের গাহিলেন মহাগীতা,
এই মাঠে হলাে মেষের রাখাল নবিরা খােদার মিতা।

ব্যাখ্যা : মসজিদ, মন্দির, গির্জা ইত্যাদি সব গুলােকেই হৃদয়ের সাথে উপমা প্রদান করেন কবি । ইসলাম ধর্মের নবী ঈসা ও মুসার হৃদয় সাধনার মাধ্যমে সত্যের সন্ধান পাওয়া, হিন্দু ধর্মের কৃষ্ণ যাকে কবি বাঁশির কিশাের বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি ও এই হৃদয় সাধনার মাধ্যমে মহাগীতা গেয়েছেন। ইসলাম ধর্মের অনেক নবীই রাখাল ছিলেন যারা মেষ চড়াতেন। সেই মেষপালক নবীরাও এই হৃদয় সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ্র বন্ধু হয়েছেন।

এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি।
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহ্বান,
এইখানে বসি গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান!
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড়াে কোনাে মন্দির-কাবা নাই।

ব্যাখ্যা : এই হৃদয় মন্দিরে বসে শাক্যমুনি বা বুদ্ধদেব ধ্যান করেছেন ফলে তিনি নিজের রাজ্য ত্যাগ করেছিলেন মানুষের দূঃখ কষ্টের কথা শােনার কারনে।কন্দর বলতে হেরা গুহা আর আরব দুলাল বলতে মহানবী(সঃ) কে বােঝানাে হয়েছে। তিনি ও সমতার গানই গেয়েছিলেন কোরআনের মাধ্যমে। কবি এসব কথাকে সত্য বলে দাবি করে বলেন এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির বা কাবা তথা সাম্য,শান্তি ও পবিত্র স্থান নেই।

প্রয়ােজনীয় শব্দার্থ:

  • পার্সি: ইরান দেশের বা পারস্যের নাগরিক
  • জৈনঃ মহাবীর প্রতিষ্ঠিত জাতি
  • কনফুসিয়াসঃ চীনা দার্শনিক
  • চার্বাকঃ বস্তুবাদী দার্শনিক
  • জেন্দাবেস্তাঃ পারস্যের অগ্নি উপাসকদের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা ও তার ভাষা জেন্দা।
  • হিয়াঃ হৃদয়
  • নিভৃতঃ নিরব
  • জেরুজালেমঃ বাইতুল মােকাদ্দিস৷ ফিলিস্তিনে অবস্থিত এই স্থানটি মুসলিম, ইহূদী খ্রিষ্টানদের নিকট সমভাবে পূন্যস্থান।
  • যুগাবতার = বিভিন্ন যুগে অবতীর্ণ মহাপুরুষ বা আবতার।
কবি পরিচিতিঃ
>> কাজী নজরুল ইসলাম<<

জন্মঃ ১৮৯৯

বাল্য-জীবনঃ ৮ বছর পিতাকে হারিয়ে দারিদ্র জীবন যাপন→ নিম্ন প্রাইমারী পাশ করে মক্তবে ১ বছর শিক্ষকতা(১৩১৬ বঙ্গাব্দ)→ বারাে বছর বয়সে লেটোর দলে পালাগান রচনা

সৈনিক জীবনঃ ১৯১৭ সালে ৪৯ নং বাঙালী পল্টনে সৈনিক হিসেবে যােগ দেন এবং করাচিতে যান। পরবর্তীতে হাবিলদার পদে উন্নীত হন।

পত্রিকার সম্পাদনাঃ লাঙ্গল, নবযুগ, ধুমকেতু ইত্যাদি

বিখ্যাত কাব্যঃ অগ্নি-বীণা, বিষের বাঁশি, সাম্যবাদী, সর্বহারা, সিন্ধু ও হিন্দোল, চক্রবাক, সন্ধ্যা, প্রলয় শিখা।

#"বিজলী" পত্রিকায় বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত
হলে চারিদিকে তার "বিদ্রোহী কবি হিসেবে
খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

উপাধি ও অর্জন সমূহঃ পদ্মভূষন(১৯৬০)
জগত্তারিণী স্বর্ণপদক, একুশে পদক ইত্যাদি।

মৃত্যুঃ ১৯৭৬ সাল
Xem thêm